গাজনের শেষ দিনের অনুষ্ঠান চড়ক। চড়ক এক শ্রেণির হিন্দুর প্রধান উৎসব। গ্রামদেশে কৃষক, কারিগর, জেলে, মালো, হাঁড়ি, মুচি, বাউরি ও বাগদি-কৌম সমাজের এই বিরাট অংশ এ সময় শিব উপাসনা করেন । বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চড়ক পুজো, নীল, হাজরহা, হরব পুজো ইত্যাদি নানা নামে পরিচিত।
পৌরাণিক সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অতিক্রম করে একটা সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবে নিজেকে জোরদারভাবে তুলে ধরেছে এই উৎসব। লিঙ্গ পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ইত্যাদিতে চৈত্র মাসের শিব-আরাধনাকেন্দ্রিক নাচ-গান ইত্যাদির বেশ কিছু উদাহরণ আমরা পাই। তবে পৌরাণিক উপাদানে এই উদাহরণগুলো কখনওই ‘পুজো’ নামে কিন্তু উল্লিখিত হয়নি।
তবে এই যে চড়কের উপাচারে বঁড়শিতে গেঁথে সন্নাসীদের ঘোরানোর দৃশ্য প্রাচীন সাহিত্যে রয়েছে বা উনিশ শতকের একদম শেষ ভাগ পর্যন্ত যার বিবরণ ইতিহাসগত ভাবে আমরা পাই, তার একটি সামাজিক দিক হল; যেসব কৃষকরা জমিদারের ঋণ শোধ করতে পারত না, সেইসব কৃষককে চৈত্র মাসের শেষ দিনে বঁড়শিতে বেঁধে ঘোরানো হত। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত এইভাবে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের উপর অত্যাচারের ইতিহাসগত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে
সেই রাতে হাজরাপুজো হয় কোনও কোনও জায়গায়। সেখানে শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি, শোলমাছ নিবেদনের পদ্ধতিও দেখেছি। গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানে এই সময়কালে শিবের ভর হওয়ার এক ধরনের প্রচলন গ্রামবাংলায় আজও আছে। অনেকেরই বিশ্বাস, সেই সময় ভক্তরা তাঁদের জীবনের নানা সমস্যা ঘিরে যা যা প্রশ্ন করেন এবং সন্ন্যাসীরা তার যথাযথ উত্তর বা দিশা দিয়ে থাকেন।
উত্তরবঙ্গের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই শিবের গাজনেরই একটা বিবর্তিত রূপ হিসেবে আমরা গম্ভীরাপুজো দেখতে পাই। মালদা, রাজশাহি অঞ্চলের একটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে গম্ভীরাপুজোর প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে নীলপুজোর যে প্রচলন রয়েছে, তা মূলত নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উচ্চবর্ণের লোকেদের ভিতরে এই পুজোর প্রচলন দেখতে পাওয়া যায় না। তবে সময়ের নিয়মে অনেক বর্ণ হিন্দুর বাড়িতেও আজকাল নীল পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
সে কালের যে কোনও উৎসবই ছিল বাবুকেন্দ্রিক। তাই দোল, দুর্গোৎসবের মতো চড়কের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন বাবুরা। চড়ক লোকায়ত উৎসব হলেও সেকেলে বাবুদের এতে উৎসাহের কমতি ছিল না। গাজনের সঙ দেখতে চিৎপুর রোড-সহ অন্যান্য রাস্তায় তখন লোকে লোকারণ্য। চড়ক উপলক্ষে সে কালেও শোভাযাত্রা বেরতো কালীঘাট অঞ্চলে। কলকাতার বিশপ হেবার এবং ফ্যানি পার্কস তাঁদের লেখায় কলকাতার চড়ক উৎসবের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সব লেখা থেকে জানা যায়, সে কালের এই শোভাযাত্রায় দেখা যেত সন্ন্যাসীদের বীভৎস সব ক্রিয়াকলাপ!
জানা যায়, সন্ন্যাসীরা সকালে কালীঘাটে গিয়ে নিজেদের গায়ে বাণ বিঁধিয়ে আসতেন। সে দিন কলকাতার পথে নামতেন হাজার হাজার সন্ন্যাসী। তাঁদের পরনে কৌপিন, সারা গায়ে সিঁদুরের দাগ, গলায় জবার মালা। সে কালে চড়কের বীভৎসতা দেখে সাহেবরাও বিস্মিত হতেন! ভয়ঙ্কর খেলাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, মোটা বড়শিতে নিজের শরীর বিদ্ধ করে চড়ক কাছে ঘোরা। আর ছিল বাণ ফোঁড়া, বঁটি ঝাঁপ এবং কাঁটা ঝাঁপ। এমনকী, মাটিতে কাঁটা বিছিয়ে তার উপর ঝাঁপও মারতেন সন্ন্যাসীরা। আবার পুরনো কলকাতার চড়কের বৈশিষ্ট্য মুখোশ নাচ কিংবা জেলেপাড়া, কাঁসারিপাড়ার সং।
এক সময় চড়কের এই প্রথাটিকেই অমানুষিক আখ্যা দিয়েছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। ১৮৬৩ থেকে ৬৫-র মধ্যে ছোটলাট বিডন এই প্রথা রদ করেন। শোনা যায়, সেই থেকেই সন্ন্যাসীরা পিঠে গামছা বেঁধে চড়কগাছে পাক খেয়ে উঠতে শুরু করেন। কাঁসারিপাড়ার কাঁসারিরা সঙ বের করতেন। অশ্লীলতার দায়ে এক সময় তা বন্ধও হয়ে যায়।
চড়কের মেলা বসে বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবুর বাজারে আর কলেজ স্কোয়্যারে। তবে কলেজ স্কোয়্যারের মেলাটি দিনে দিনে ছোট হয়ে এসেছে। ছাতুবাবুর বাজারের মেলাটি আজও কলকাতার সবচেয়ে বড় চড়কের মেলা। চৈত্র সংক্রান্তির দিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই এখানে মানুষের ঢল নামে।
এই উৎসবের উদ্ভব মনে হয় কোনো আদিম সমাজ থেকে। কারন চরকের মতোই মক্সিকো তেও অনুষ্ঠিত হয় এক প্রাচীন প্রথা , যার নাম The Danza de los Voladores.
Photo by Anya Juárez Tenorio
চড়কের অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, উৎসব-কেন্দ্রিক ছড়া ও গীতি। কথ্যভাষায় রচিত এই ছড়া ও গানের মধ্যে দিয়ে স্থানীয় স্তরে দেশজ সংস্কৃতির হদিস মেলে। গাজন বা চড়কের মতো দেশজ এই সংস্কৃতি বাংলায় জাতীয়তাবাদের প্রসারেও সহায়ক হয়েছিল।




Comments
Post a Comment